শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২৩ অপরাহ্ন
বর্তমানে কিছু উট্কো লেখক আর সাংবাদিক তৈরী হয়েছে। এরা সংবাদ পরিবেশনে এতটাই ফাস্ট, এতটাই এক্সপার্ট; মনে হয় টিভি চ্যানেলগুলোকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটিতে ইচ্ছেমত সংবাদ তৈরী করে যেভাবে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে- তাতে সংবাদ পরিবেশনার আসল যে মাধ্যম, সেগুলো অনেকটাই বিশ্বাস যোগ্যতা হারাচ্ছে। কোনো প্রশিক্ষণ আর যোগ্যতা ছাড়াই ওইসব মাধ্যমে পরিবেশন করা হচ্ছে মুখ-রোচক সংবাদ (সম্ভবতঃ অতিরিক্ত লাইক-কমেন্ট্স পাওয়ার আশায়)। যেন-তেন একটা স্মার্ট ফোনে ছবি কিংবা ভিডিও করে তা আবার লাইভে পাঠাচ্ছে। এদের মিডিয়াতে কোনো সাংবাদিক কিংবা সম্পাদক লাগেনা। এ সংক্রান্ত কোন কার্ডেরও প্রয়োজন পড়েনা এদের। এরা নিজেরাই সব! এদের এই সংবাদগুলোর কোনোটির ভিত্তি আছে আবার কোনোগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন বা ভূয়া। আমরা পড়ছি আর পড়ছি।
ভালো কথা। আপনি একটা তথ্য দিচ্ছেন, সেবা দিচ্ছেন, এজন্য আপনাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু আপনার সংবাদ পরিবেশনের স্টাইলটা একটু ভিন্ন রকমের; যেটা সত্যি বিরক্তিকর। যারা এ ধরেনের সংবাদ পরিবেশন করছেন, তারা কি একবার চিন্তা করে দেখেছেন আমি কি লিখছি? কীভাবে লিখছি? আমার ভাষা আর বানান ঠিক আছে কিনা? খবরের পছেনের ওথেনটিকেশন, রেকর্ডসমূহ আমার সংগ্রহে আছে কিনা। আপনি কিসের ওপর ভিত্তি করে নিউজটা ছেড়ে দিচ্ছেন? এ বিষয়গুলো গুরত্বসহকারে নিতে হবে।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- ‘যার কাজ তাকেই সাজে, অন্যের গলায় কাঁটা বাজে।’ কাজেই, যার যেটা কাজ তাকে সেটাই করতে দিন। ধরা যাক, আপনার শক্ত কোনো অসুখ হয়েছে। আপনি কি তখন নিজের চিকিৎসা নিজেই করান? উপরন্তু বাড়ির পাশের হাতুড়ে ডাক্তার, যে আপনার একটা ফোন পেলেই চলে আসে, তাকে ছেড়েও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর জন্য শহরে চলে যান। কারণ, আপনি বুঝতে পারেন, এটা আমার বা ঐ হাতুড়ে ডাক্তারের কাজ নয়। এটা ঐ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাজ। অতএব, যার যার পেশাগত কাজ, তাকেই করতে দিন। এটা আপনাকে বা আমাকে দিয়ে সম্ভব হলেও ফলাফল ভালো আসবেনা। এজন্যই তো বিভিন্ন পেশার মানুষ আমাদের এই বাংলাদেশে।
আবার, প্রত্যেক ভাষার ভাব প্রকাশের একটা নিজস্ব স্টাইল থাকে। যেমন কবিতার ভাষা কবিতার মতই হওয়া চাই, নাটকের ভাষা নাটকের মত, এ রকম গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গীতিকবিতা যাই বলুন না কেন- ভিন্ন ধারার সাহিত্যে ভাষার স্টাইল আপনার ভাব প্রকাশের জন্য বিভিন্নতা এনে দেবেই। তেমনি, পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রেও একটা নিজস্ব ভাষা অনুসরণ করতে হয়। আপনি কি এসবের দিকে নজর দিচ্ছেন? এগুলো তো দুরের কথা, বরং আপনি একটা সংবাদ (Journal) কে প্রতিবেদন (Report) হিসেবে গুলিয়ে দিচ্ছেন। সংবাদকে ভাব আর আবেগ মিশিয়ে তাকে সাহিত্য হিসেবে তৈরী করছেন। এর মানে আপনি জানেন না- সাংবাদিকতা আর সাহিত্য কি জিনিস। এদের মধ্যে কি ধরনের পার্থক্য আছে। দয়া করে একটু জেনে নিয়ে নিজেকে যাচাই করে দেখুন। আমার কথায় কেউ বিরক্ত হবেন না। আমি আপনাকে ছোট করাচ্ছি না। আপনি লিখবেন; সেই পথটাকে দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি মাত্র। আপনার লেখাটি যেন সর্বজন পঠনযোগ্য হয়।
মনে রাখবেন, সাহিত্য আর সাংবাদিকতা কিন্তু এক না। আপাত দৃষ্টিতে দুটির মধ্যে মিল-বন্ধন পরিলক্ষিত হলেও এদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। সাহিত্যে কল্পনা, আবেগ প্রাধান্য পায়। কিন্তু সাংবাদিকতায় এ দুটোর কোনোই স্থান নেই। সাহিত্য হচ্ছে ভাবের বিষয়, সাংবাদিকতা ভবের বিষয়। এটা হচ্ছে বাস্তবভিত্তিক ক্লাসিক্যাল। আরও পরিস্কার করে বলতে গেলে- সাংবাদিকতা হচ্ছে- দেখা থেকে লেখা। তুচ্ছ বিষয় নিয়েও সুন্দর সুন্দর সাহিত্য রচনা করা যায়, কিন্তু সংবাদ পরিবেশন হয়না। এ প্রসঙ্গে চার্লস আন্ডারসন ডানার উক্তিটি প্রণিধান যোগ্য। তিনি সংবাদ ও সাংবাদিকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন-
“When a dog bites a man that is not news, but when a man bites a dog that is news.”
অর্থ্যাৎ- যখন একটা কুকুর মানুষকে কামড়ায় সেটা কোনো সংবাদ নয়, কিন্তু যখন একটা মানুষ কুকুরকে কামড় দেয় সেটাই সংবাদ। অথচ ফেসবুকের মত একটা জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমকে আমরা এভাবেই ব্যবহার করছি।
আমরা যারা ফেসবুকসহ, সংবাদপত্র, বিভিন্ন গণ-মাধমে কিংবা অন্যান্য সোস্যাল মিডিয়াতে অবাধে নিজের খেয়াল খুশী মত এসব তথ্য সন্নিবেশিত করছি, তাদের সবার ৫৭ ধারার ডিজিটাল অ্যাক্ট (Act) টিকে মাথায় রাখা দরকার। ২০০৬ সালে আইসিটি আইনটি প্রণয়ন করা হয় এবং ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। এই আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে-
‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কার্য হবে একটি অপরাধ। এ অপরাধের জন্য অনধিক ১৪ বছর ও অন্যুন ০৭ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ০১ কোটি টাকা অর্থ দণ্ডে দণ্ড দেয়া যাবে।’ অথচ, সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-
‘৩৯। ২ (ক) নাগরিকদের বাক্ ও ভাব প্রকাশের অধিকারের এবং
‘৩৯। ২ (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
আইনজীবীদের মতে, সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদের ২ (ক)- এর সঙ্গে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা সাংঘর্ষিক। এখানে মতপ্রকাশের অধিকার দেয় হয়েছে। কিন্তু আইসিটি আইনে তাতে বাধা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কেন? এর কারণ হিসেবে ‘বিডি২৪লাইভ’- এর সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক আরেফিন সোহাগ “সাংবাদিক ও আইনের ৫৭ ধারা” শিরোনামের প্রবন্ধে মন্তব্য করেন-
‘একজন প্রকৃত সাংবাদিক সব সময় দেশের সংবিধান ও আইন মেনেই চলেন। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো খবর তৈরি করেন না। এখানে একটা কথা না বলে পারছিনা, সমাজে কিছু হলুদ সাংবাদিক রয়েছে। এদের কারণেই দেশের রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণের ভাবমুর্তি নষ্ট হয়। আর এদের কারণেই আজকের এই ৫৭ ধারা।’ এ্যাক্ট ফিফটি সেভেনের জন্য মূলত: এরাই দায়ী। চিন্তা করে দেখেছেন, মাত্র কয়েকজনের জন্য আপনাদের গোটা সাংবাদিক সমাজের কী হাল!
এছাড়াও প্রেস কাউন্সিল এ্যাক্ট, ১৯৭৪ এর ১১ (এগার) টি ধারার মধ্যে প্রয়োজনে কয়েকটি ধারা আমি লেখার খাতিরে তুলে ধরছি। সেখানে (৩) নং ধারায় বর্ণিত আছে, ‘জনগণকে আকর্ষণ করে অথবা তাদের ওপর প্রভাব ফেলে এমন বিষয় জনগণকে অবহিত রাখা একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব। জনগণের তথা সংবাদপত্রের পাঠকগণের ব্যক্তিগত অধিকার ও সংবেদনশীলতার প্রতি পুর্ণ সম্মানবোধসহ সংবাদ ও সংবাদভাষ্য রচনা ও প্রকাশ করা।’
(৭) নং ধারায় লেখা আছে, ‘ যে সকল সংবাদের বিষয়বস্তু অসাধু এবং ভিত্তিহীন অথবা যেগুলোর প্রকাশনায় বিশ্বাস ভঙ্গের আশঙ্কা আছে সে সকল সংবাদ প্রকাশ না করা।’
(৮) নং এ উল্লেখ আছে, সংবাদপত্র ও সাংবাদিক বিতর্কিত বিষয়ে নিজস্ব মতামত জোরালোভাবে ব্যক্ত করার অধিকার রাখেন। তবে সে সাহস আর চ্যালেঞ্জ তার থাকতে হবে।’
(১১) নং ধারাটিতে বলা আছে, ‘ব্যক্তি বিশেষ, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা কোনো গোষ্ঠি বা শ্রেণির মানুষ সম্পর্কে তাদের স্বার্থ ও সুনামের ক্ষতিকর কোনো কিছু সংবাদপ্ত্র প্রকাশ করে তবে পক্ষপাতহীনতা ও সততার সাথে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকের উচিত ক্ষতিকর ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান/সংস্থাকে দ্রুত এবং সংগত সময়ের মধ্যে প্রতিবাদ বা উত্তর দেয়ার সুযোগ প্রদান।’
আমরা রিপোর্ট লেখার সময় এগুলোকে কী আদৌ মেনে নিয়ে আমাদের দায়িত্ব পালন করছি? নাকি ফেসবুকের পাতায় পাতায় দায় সারা একটা ব্রেকিং নিউজ করে সুপার হিট হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। আশাকরি এরপরে অন্তত: এ বিষয়ে আর কিছু বলতে হবেনা।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কি নতুন প্রজন্ম সাংবাদিকতার পেশায় আসতে পারবেনা? উত্তরে বলব- অবশ্যই আসবে। তারাই তো পুরাতনদের হাল ধরবে, তাঁদের যোগ্য উত্তরসুরী হবে। তবে এ জন্য তরুণদের যোগ্য করে নিতে হবে। আর এটার দায়িত্ব নিতে হবে প্রবীণদেরকেই। এজন্য যারা নবীন, তাদের উচিত প্রবীণদের সান্নিধ্য লাভ করা।
আমি সাংবাদিক বা সংবাদ কর্মী বলতে যা বুঝায়, তার কিছুই নই। কাজেই হলুদ, লাল, নীল, সবুজ- এক কথায় ‘বেনীআসহকলা’- সাংবাদিকতা নিয়ে মন্তব্য করার অভিজ্ঞতাও আমার নেই। আমি শুধুমাত্র একজন পত্রিকা পাঠক এবং শ্রোতা। বিভিন্ন মাধ্যমে একটু হলেও আমি দেশ-বিদেশের (বিশেষ করে নিজের এলাকার) খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করি। সংবাদ, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়গুলো অত্যন্ত যত্ন সহকারে পড়ার চেষ্টা করি। একটা লেখার সাথে আরেকটা লেখার তুলনা করি। কোন লেখাটা আমার ভালো লাগল এবং কেন লাগল কিংবা কোনটা ভালো লাগলনা আর কেনই বা লাগলনা এর উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। এতটুকুই আমার অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার বল নিয়েই লেখার অপচেষ্টা করছি মাত্র।
যা হোক, দুঃসাহস করে অনেক কথাই বলে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না। পরিশেষে আমার শ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক ভাইদের বলছি। আপনারা সমাজের দর্পণ। ১৭/১৮ কোটি মানুষ আপনাদের কলমের আয়নায় সারা কিশ্বের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। আপনারা হাজার কষ্ট করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ সংগ্রহ করে আমাদের কাছে পৌঁছে দেন। দেশের উন্নয়ন তথা সাধারন বঞ্চিত, নির্যাতিত নাগরিকদের মুখপাত্র হয়ে কাজ করেন। আপনারাই হিরো। আপনারা শক্ত ও সৎ থাকেন। দেখবেন, আপনারাই টিকে আছেন। হলুদ সাংবাদিকরা তো ল্যাম্প পোস্টের বাতি। যে অংশে আলো পড়ে, সেটুকুই আলোকিত করে। ওরা তো অন্ধকারে বিদ্যুৎ চমকানোর মতই একটি মাত্র ঝলক দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। যতক্ষণ আলো দেয়, ততক্ষণ আলো পায়। বাকী সময়টা সূর্যের জন্যই অপেক্ষা করতে হয়। আপনারা হলেন সূর্য। আপনাদের আলো সারা বিশ্বকে আলোকিত করে তুলছে।
লেখক: শিক্ষক, কবি, কলামিস্ট ও সহকারী শিক্ষক, জাহাঙ্গীরাবাদ দ্বি মুখী উচ্চ বিদ্যালয়, পীরগঞ্জ, রংপুর rangasarker100@gmail.com.