মোটর সাইকেলে মন্ডলের বাজার জামে মসজিদ মোড় ঘুরতেই হঠাৎ করে চোখ পড়ল এই প্রবীণ মানুষটির দিকে। পড়নে একটা সাদা ফ্যাকাশে পাজামা আর গায়ে গাঢ় ছাই রঙের পাঞ্জাবী। পায়ে পুরাতন জুতো। চশমাটা বুক পকেটে গুজিয়ে রেখেছেন। প্রবীণ আসছেন; বীর বেশে। লাল রঙের ছোট্ট একটা পুরাতন সাইকেলে করে। এই বয়সেও তেজস্বী যুবকের মত সমানে চেনের ঘড়্ ঘড়্ শব্দে প্যাডেল ঘুরিয়ে।
এমন একটা দৃশ্য আমার মনে অনেকখানি দাগ কেটে দিল। বাইক থামিয়ে তাই ছবি নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু প্রস্তুতি নিতে নিতেই মোড় পাড় হয়ে অনেকখানি দূরত্ব অতিক্রম করল। মনটা খারাপ হলো আমার। ইস! দারুণ একটা মূহুর্ত মিস করে ফেললাম। সে যাই হোক, অল্প কিছুক্ষণ পরেই একটা বিশেষ কাজে বাজারের বাইরে যেতে হলো। মোটর বাইকেই বসে আছি। হঠাৎ দেখি, সেই মানুষটি আবারও সাইকেল মাড়িয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছেন। ভাবলাম, এ সুযোগ আর হাতছাড়া করবনা। ওনার অজান্তেই ছবিটি আমার স্মার্ট ফোনের ক্যামেরায় বন্দি করে ফেললাম। হ্যাঁ। উনি আমাদের যতিন স্যার (যাকে আমি দাদু হিসেবে সম্বোধন করি)। আমার দুই চাচা-ই ওনার ছাত্র।
যতিন স্যার; পুরো নাম শ্রী যতিন চন্দ্র বর্মন। বাড়ি: রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বাজারপাড়া গ্রামে। তিনি শুধুমাত্র একজন মানুষ নন; একটা দৃষ্টান্তও বটে। শত অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে ১৯৬২ সালে মেট্রিকুলেশন (বর্তমান এসএসসি) পাশ করার পর বড় শখ করে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ইংরেজিতে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। তখনকার এই যোগ্যতা মানেই একটা বিশাল কিছু। সেই যূগে এত ভালো যেগ্যতা নিয়েও অনেক ভালো ভালো চাকরীর সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করেছিলেন তিনি। তাঁর ইচ্ছে, তিনি শিক্ষকতা করবেন। তাঁর জ্ঞানের আলো সবার মাঝে বিলিয়ে দিয়ে সবাইকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। এ জন্যই এমন সিদ্ধান্ত।
অবশেষে তাই হলো। রংপুরের পীরগঞ্জে পানবাজাার ডি এম দ্বি মুখী উচ্চ বিদ্যালয় ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন। সেবা দিয়ে গেলেন ৩০টি বছর ধরে।
ওনার সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল অনেক প্রতিষ্ঠানেই। উনি যখন অবসরে যান, তখনও আমি ছাত্র। ঐ সময়ে যে সব কোচিং সেন্টারের সাথে উনি যুক্ত ছিলেন, সেই সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে খানিকটা চাপ প্রয়োগ করে আমাকেও যুক্ত করার সুযোগ করিয়েছিলেন। শিক্ষকতা পেশায় আমি নতুন। তাই মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের সাথে বেঞ্চে বসে আমি ওনার ক্লাস উপভোগ করতাম। ইংরেজি পড়াতেন উনি। সে কি সুন্দর উপস্থাপনা! নিউ ওয়ার্ড আর কী-ওয়ার্ডের খুটি নাটি বিষয়গুলো উদ্ধার করে ছাড়তেন। ওনার ইংরেজি ভাষায় উপস্থাপনা দেখে শুধু হা করে চেয়ে থাকতাম। অর্থ জানতে চাইলে ডিকশোনারি দেখার পামর্শ দিতেন। নিজে কখনই বলে দিতেন না। উনি বোঝাতেন ‘এই একটা অর্থ খুঁজতে নিশ্চই তুমি আরও দশটা শব্দের সাথে পরিচিত হয়ে তাদের অর্থ উদ্ধার করতে পারবে।’
কিন্তু হায়রে ভাগ্য! সময়ের সাথে বার্ধক্য যেন পাল্লা দিয়ে চলল। একের পর এক এক করে নিভিয়ে যেতে লাগল জীবনের সঞ্চিত জ্ঞানের সেই প্রজ্জ্বলিত প্রদ্বীপগুলো। দীর্ঘ ৩০টি বছর যে মানুষটি জ্ঞানের প্রদ্বীপ হয়ে হাজার হাজার আলোর মশাল জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন; এখন তাঁকে উদ্ধার করার মত কেউ নেই। নিকষ কালো অন্ধকারে তীর খাওয়া পাখিগুলো নীড় হারা যেমন পাখা ঝাপটায় জীবনের জন্য, তেমনি উনিও এখন দাপিয়ে মরছেন জীবিকার জন্য। কল্যাণের মাত্র কয়েকটি টাকা পেয়ে তার সাথে কিছু জমি বিক্রি করে কন্যা দায় সেরেছেন। এই বৃদ্ধ বয়সে না খেয়ে না দেয়ে পুরাতন একটা সাইকেল নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন আর খুঁজছেন একটা প্রাইভেট অথবা টিউশনি। আমাকে অনেক দিন বলেছিলেন-
‘দাদু, তোমার স্কুলে কি একটা ক্লাস নেয়ার সুযোগ করে দেবে? যা পারো দিও। আমি সমস্যা করবনা। শুধু অনুমতিটা…….।‘
আমি হ্যাঁ বলার সহস পাইনি। কারণ, এই বিষয়ে বেসরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কমিটির সম্মতি ছাড়া হ্যাঁ বলার কোন ক্ষমতা একজন সাধারণ শিক্ষকের নেই। তবে সুপারিশ করেছিলাম ওনার জন্য।
অবশ্য এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলি ও শিক্ষার্থীবৃন্দ তাঁকে সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য করেছিল আমার হাত দিয়েই। যে দিন আমি ওনার হাতে টাকাটা তুলে দেই, সে দিন ওনার চোখে মুখে যে কৃতজ্ঞতার ছাপটুকু দেখেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা। উনি বার বার উচ্চারণ করেছিলেন-
“At the moment I needed this money. You have done this work cordially. You’re the Great. Your school is the great and your staff is so kindness. I wish to have a better feature. May God bless you all.”
আমি তাকিয়ে দেখলাম- দাদুর চোখের কোণায় দু’ফোটা জল মুক্তোর দানার মত চিক চিক করছে। আমি ওনার হাত ধরে বিনীত অনুরোধ করে বললাম-
‘Don’t worry Dadu. You’re the Great Person. We’re on your side all the time. That will be the same for ever. Thanks a lot Dadu. Salute to you.’
এরপর অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গুলিতেও আমি ওনার জন্য ধর্না ধরে ছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু একটা কথাই সবাই বলে- ওনার বয়স হয়েছে। সেই শক্তি সামর্থ্যও আর নেই। বর্তমান সিলেবাস এবং শিক্ষার্থী উভয়ই ওনার জন্য ফিট নয়। তাছাড়া ওনার কথাও নাকি স্পষ্ট আর বোধগম্য নয়। ইংরেজি উচ্চারণ শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে বুঝতেও পারেনা।‘ তখন আমি নীরবতার ভূমিকায় অভিনয় করেছি মাত্র।
ওনার সম্পর্কে এই লেখাটা দাঁড় করাতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ফোনে কথা বলতে হয়েছিল। এক-একটা প্রশ্ন ৫ থেকে ৭ বার রিপিট করতে হয়েছিল। উনি নিজেও লজ্জিত। অবশেষে বললেন,
‘দাদু, অসুখে ভূগছি। আজকাল কানেও আর খুব একটা শুনতে পাচ্ছিনা।‘
ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যখন জানতে চেয়েছিলাম তখনও উনি বলেছিলেন-
‘দাদু, এমন প্রশ্ন করছ কেন? কোনো অনুদান!’
আমি অনেক্ষণ নির্বাক হয়ে ছিলাম। ভাবছি, কতটা অসহায় হলে মানুষ এমনভাবে বলতে পারে! এরপর শুধু বলেছি- ‘দাদু, একটা রিপোর্ট করব। জাতি দেখুক, অবসর নেয়া বেসরকারী শিক্ষকদের কী হাল!
উনি স্থানীয় বাজারে আমার আশায় পথ চেয়ে বসে থাকতেন ওনার কাজের খবর শোনার জন্য। আমাকে দেখলেই ফোকলা হাসি দিয়ে বলতেন-
‘ওহ্ ইয়াং ম্যান! খবর বলো ?’ আমি মাথা নিচু করে থাকতাম। খানিক্ষণ পর উনি উত্তর করতেন- ‘ডোন্ট ওরি ইয়াংম্যান। আমি বুঝতে পেরেছি। নাউ আই অ্যাম আনফিট। তবে মনে রেখ হে, আজ যদি আমার ক্ষেত্রে অবসর ভাতার প্রথাটি চালু থাকত, তাহলে হয়ত এমন করে সবার দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিতে হত না। যদি আমি তোমাদের মত ইয়াং থাকতাম, তাহলে আমার কষ্টের কথা মনে করে তোমাদের জন্য সরকারের কাছে হাত পেতে বসতাম আর বলতাম- মা রে, আমরা নিজ হাতে প্রতিষ্ঠান গড়ে অভিভাবক হিসেবে কষ্ট করেছি কাদের জন্য? ওদের জন্যই তো। ওরা তো আমাদের সন্তান। ওদের কষ্ট দিও না। কারণ, ওরা ভালো থাকলে আমরা আমাদের কষ্টগুলো ভুলে যাবার একটা রাস্তা তো অন্তত: পেতাম। তবে ঈশ্বরের কৃপায় তোমরা পাবে আশা করছি।‘
এরপর ফোকলা দাঁতে একটা কষ্টের হাসি দিয়ে বললেন-
আমি? ওহ্ ইয়াংম্যান। আই অ্যাম অ্যান আইডল পেনি নাউ। আমি এখন অচল পয়সা।’ অ্যারেন্ট্ আই?’
দয়া করে সবাই স্যারের এই প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজে বের করুন। ভাবুন, আপনি আমি কোথায আছি, আমাদের এই স্যার কোথায় এবং কেমন আছেন?
ভেবেছিলাম গতকালেই লেখাটি পত্রিকায় পাঠাবো। কারণ, গতকাল ছিল শিক্ষক দিবস। এই শিক্ষক দিবসে অন্তত: একজন শিক্ষক কে স্মরণ করে দিনটির তাৎপর্য বৃদ্ধি করব। কিন্তু না। আমি যে স্যারের কথা লিখলাম, তাঁর জন্য এই দিবসটি প্রযোজ্য নয়। তিনি এখন অচল পয়সা।