শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:২০ পূর্বাহ্ন
এ টি এম আশরাফুল ইসলাম সরকার রাংগা:
সফর আলীর বাবার বেজায় অসুখ। হাতুড়ে ডাক্তারের ঔষধ পথ্যে আর কোনো কাজই হচ্ছেনা। সবারই এক কথা, সফর আলীর বাবাকে এবার সদরে নিয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে হবে। গ্রামের ডাক্তারের আর সাধ্যি নেই তাকে সুস্থ করে তোলার। সফর আলীর হাতের পরিস্থিতিও খুব খারাপ। অগত্যা আর কি। আত্মীয়তাসূত্রে এক পরিচিত মানুষের সাথে ফোনালাপের মাধ্যমে বাবাকে নিয়ে সে শহরে একটা কিনিকে উঠবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। পরদিনই সফর আলী তার বাবাকে নিয়ে পরিচিত সেই মানুষটির পাঠানো মাইক্রোবাসে করে কিনিক অভিমুখে রওনা দিল। সফর আলী এখন কিনিকের বারান্দায়। জনা চারিক লোক এসে তার বাবাকে অতি যতেœ গাড়ি থেকে নামিয়ে কেবিনে নিয়ে যায়। সফর আলীও চলে পেছনে পেছনে। রোগীর পরী-নিরীা শুরু হতে চলেছে। সফর আলী তার বাবার পাশে অপেমাণ। শ্বাসকষ্ট টা যেন কিছুতেই থামছে না। কিনিকে অনেক মানুষ, অথচ সফর আলীর বাবার কাছে কেউ ঘেষছেনা। এমন সময় হঠাৎ একটা লোক এসে সফর আলীকে ম্যানেজারের সালাম পৌঁছে দেয়। সফর আলী এবার বাবাকে রেখে সেদিকেই ছুটে চলে। কাঁচ বাঁধানো ঘরে কিনিকের ম্যানেজার সাহেব তখন একটা ফরমে অযথা কলম ঘষছেন। কলম ঘষা অবস্থায়ই তিনি সফর আলীকে জিজ্ঞেস করলেন- – রোগীর কে হন? – ব্যাটা। – রোগীর অবস্থা খুব একটা ভালো না। সে যাই হোক, ওনাকে ভর্তি করাতে হবে। তা- টাকা-পয়সা কি কিছু এনেছেন? সফর আলী তার কোমরে লুঙ্গিতে বাঁধা খুঁতিয়াটা এবার আলগা করে। – জে ছার। – ফিফটি পার্সেন্ট দিয়ে দিন। -সফর আলী মনে মনে চিন্তা করে, কত দিতে হবে তাকে। একশ টাকা! না খুব বেশি হয়ে যায়। গ্রামে তো সে ডাক্তার ও ওষুধ-পত্র বাবদ মাত্র পঞ্চাশ টাকা দিয়েছে। এখানে কেন সে এত দেবে? তাছাড়া, এখানে তার একজন পরিচিত মানুষও আছেন যিনি মাইক্রোবাস দিয়ে সফর আলীকে এতদূর পর্যন্ত এনেছেন। এরুপ নানান টা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত সফর আলী খুঁতিয়া থেকে একটা একশত টাকার নোট বের করে দেয়। ম্যানেজার সাহেব এবার ঠোঁট একপাশে বাঁকা করে ভেংচি মেরে হেসে উঠলেন। – এটা কি দিলেন আপনি? – ক্যানে? হামি তো অনেকগুলা ট্যাকা দিনো ছার। – আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আপনি জানেন, আপনি কোথায় এসেছেন? এই বলে ম্যানেজার সাহেব আনুমানিক একটা টাকার হিসেবের ফর্দ সফর আলীর হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেখানে কোনোপ্রকার ওষুধ পত্র ছাড়াই প্রায় দশ-বারো হাজার টাকার একটা হিসেব। সেটাও নাকি সেই আত্মীয়ার কারণেই বিশেষ ছাড় পেয়েছে। সফর আলী চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়, চিন্তা করে। এত টাকা সে দেবে কেমন করে? এরপরেও নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুণ পরে বলে- -ছার, আর একশ দেমো। বাপের চিকিৎসা হবি তো? ম্যানেজার সাহেব সফর আলীর দিকে না তাকিয়েই এবার কাগজপত্র গুটিয়ে তাকে পরামর্শ দেন- – হবে। তবে এখানে নয়। সরকারী হাসপাতালে যান, সেখানে বিনা পয়সায় চিকিৎসা হবে। বুক ভরা আশা নিয়ে সফর আলী তার বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকেই ছোটে। বিশাল হাসপাতাল। সফর আলী নীচ থেকে ওপরের দিকে গোণে। এক তলা -দুই তলা -তিন তলা -চার তলা- আরও কত! গুনে গুনে ভুল করে। আবারও গুণতে শুরু করে। ওরে বাপরে! এতবড় হাসপাতাল। সফর আলী এখন প্রায় নিশ্চিত। তার বাবার চিকিৎসা এবার ঠেকায় কে। দু’জন স্ট্রেচারে করে সফর আলীর বাবাকে জরুরী বিভাগে নিয়ে যায়। সফর আলীও চলে। কিন্তু তার বড্ড দেরী হয়ে গেছে। কোনোকিছু বোঝার আগেই তার বাবা কোথ্থেকে যে হাওয়া হয়ে গেল, সফর আলী নিজেও জানলনা। শুধুমাত্র হাসপাতালের এ মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত দৌড়াতেই লাগলো। অবশেষে অতিকষ্টে এক লোকের সাহায্যে সফর আলী তার বাবার ওয়ার্ড টা খুজে বের করে। দেখে, তার বাবাকে কেবিনের বাইরে মেঝেতে শোয়ানো হয়েছে আর ওয়ারিশ কে গরু খোঁজা খোঁজানো হচ্ছে। সফর আলী বাবার শিয়রে বসে। শুধু সফর আলীর বাবা-ই নয়, আরও অনেক রোগী সেখানে এভাবেই শুয়ে আছে। ডাক্তার, নার্স সারাণ টহল দিচ্ছেন হাসপাতালে। এ ওয়ার্ড থেকে ও ওয়ার্ড, এক কেবিন থেকে অন্য কেবিন। সফর আলী শুধু চেয়ে দেখে। একবার ওদের দিকে, আরেকবার তার বাবার দিকে। অবশেষে একজন নার্স এসে সফর আলীকে প্রশ্ন করে-
– এ রোগীর ওয়ারিশ কি আপনি?
– জে।
– কোথায় ছিলেন এতণ?এমনিতেই তো রোগীর বারোটা বাজিয়েছেন।
অতঃপর একটা কাগজে দু’কলমে ঘচ ঘচ করে লিখে বললেন-
– যান। এই ওষুধগুলো তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন। আর শুনুন, ওনার অনেকগুলো পরীা করাতে হবে। এক্র-রে, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ব্লাড, ইউরিন, স্টুল এমকি প্রয়োজনে সিটি স্ক্যানও করানো লাগতে পারে। আপাতত; কোনো বেড খালি নেই। তাই অক্সিজেন দিতে পাচ্ছিনা। বেড খালি হলে আমরা অক্সিজেন প্রয়োগের ব্যবস্থা করে দেব।
সফর আলী বিনয়ের সাথে হাতজোড় করে নার্স কে অনুরোধ করে-
– বইন, একনা কতা কই। হামার আব্বা মাজিয়াত (মেঝেতে) খুব কষ্ট পাতিচি। এমনিটি হাপানীর রুগী। তাই কই কি, ঐজি দুকনা চকি ফাকা আচে। হামার আব্বাক্ ওটি এনা শোতাইলে হইলনা হয়।
সফর আলীর পোশাকের দিকে তাকিয়ে আপা সায় দেয় না। ও দুটো পেয়িং বেড। ওগুলো সফর আলীদের জন্য নয়। ওখানে থাকতে গেলে বেডের জন্য ভাড়া দিতে হয়। উপরন্তু ওষুধগুলো কেনার জোড় তাগিদ দিয়ে আপা ছর ছর করে অফিস করে দিকে ছুটতে থাকে।
সফর আলীও ম্যাডামের পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু ম্যাডাম ততণে ঘরের ভেতরে।
সফর আলী জানে এখানে ফ্রি-তে সবকিছু চিকিৎসা করানো হয়। এর আগের ম্যানেজার স্যারও তাই বলেছিলেন। কিন্তু সে জানেনা কোথায় এই ঔষধ গুলো পাওয়া যাবে। অসুস্থ বাবাকে রেখে অনেণ ঘোরা-ঘুরি করে সে হাসপাতালের এক বয়ের মাধ্যমে জানতে পারে মেডিসিন স্টোরের ঠিকানা। অবশেষে সেখানে গিয়ে সে আপার লেখা কাগজটি বের করে দেয়। কিন্তু কাগজটি এক নজর দেখার পরেই সফর আলরি হাতে ফেরত আসে। সে ফেরত আসার কারণ জানতে চায়। কর্তব্যরত লোকটি তাকে অতি বিনয়ের সাথে জানিয়ে দিলেন যে এখানে ঐ সব ঔষুধ পাওয়া যাবেনা। তাকে বাহির থেকে কিনে আনতে হবে। করণ সব ঔষধ হাসপাতালে পাওয়া যায়না। এজন্য অবশ্য তারা আন্তরিকভাবে দু:খ প্রকাশ করেন।
সফর আলী একটু আঁতকে ওঠে। এমন তো কথা ছিলনা। এর আগের ডাক্তার তো বললেন, এখানে থাকা খাওয়ার কোনোই সমস্যা নেই। এখানে ফ্রিতে চিকিৎসা হয়। তবে এরা টাকা দিয়ে ওষুধ কিনতে বলছে কেন? তাও আবার এই হাসপাতালের বাহিরে থেকে। এটা কেমন কথা।
সফর আলী এবার পণ করে বসে। সে এবার সবগুলো কথা আপাকে খুলে বলবে। নিশ্চয়ই আপা এর কোনো ব্যবস্থা নেবেন।
সফর আলী অপোয় থাকে। কিন্তু ম্যাডাম বের হয় না। ওদিকে বাবার এ্যাজমার টান টাও বেশ বেড়ে যায়।
সফর আলী কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই মুহূর্তে যদি তার বাবাকে ইনজেকশন, ইনহেলিং কিংবা নেবুলাইজিং না করানো যায়, তাহলে উনি ঝুঁকিতে পড়বেন। অন্যদিকে ম্যাডামের সাথে দেখা না করলে তার বাবার ওষুধ-পত্রের কোনো ব্যবস্থাই হবেনা। কারণ তার হাতে কোনো টাকা নেই। তাই সিদ্ধান্ত নেয়, সে অপোই করবে।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর ডাক্তারের দেখা মিলল। সফর আলী ডাক্তারের পিছু নিলেন। এবার কোনোমতেই ডাক্তার কে হারাতে নারাজ। ডাক্তার সাহেব গুটিকতক ছেলে-মেয়ে নিয়ে সফর আলীর বাবার দিকেই যাচ্ছেন। সফর আলী খুশি হয়। ডাক্তার তার বাবার শরীরের বিভিন্ন অংশ পর্যবেণ করে। তার সাথের ছেলে-মেয়েদের প্রশ্ন করছেন ও বোঝাচ্ছেন। ওরাওও মাঝে মাঝে পরীা করছেন। সফর আলী জিজ্ঞেস করে-
– ছার। ক্যাংকা দেকনেন্।
ডাক্তারের জবাব আসে-
– সরি। উনি নেই। অনেক আগেই মারা গেছেন। আমাদের ব্যবহারিক কাশ ছিল। তাই এক্সপেরিমেন্ট করলাম মাত্র। আপনি ওনাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে পারেন।
বাবার এই সংবাদ শুনে সফর আলী হতবাক হয়ে গেলেন। কান্নাও যেন তার সাথে প্রতারণা শুরু করল। বুক ফেটে যায় তবু কান্না আসেনা। অবশেষে পাথর গলে গেল। এতণের জমানো কান্না এবার গগনবিদারী নাদে প্রতিবাদের কণ্ঠ পেল-
“ইয়া আল্লাহ! তুই গরিবের এতবড় অসুখ দেস ক্যান্। আর যদি দিবি তবে ট্যাকা দিস না ক্যান? যেইখানে ট্যাকা ছাড়া কোনো চিকিৎসা নাই, সেইখানে গরিবের আবার কিসের অসুখ? দুনিয়ার সকল গরিব শোনো, এই দুনিয়ায় গরিবের কোনো চিকিৎসা নাই, চিকিৎসা নাই, চিকিৎসা নাই”।
এরপর বাবার লাশটা কাঁধে করে চোখ মুছতে মুছতে সফর আলী বাড়ির পথে রওনা দেয়।