শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৪৩ অপরাহ্ন
পীরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি: পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হচ্ছে-একজন নারীর সন্তান প্রসব বেদনা। আর যখনি তার কলিজার টুকরো সন্তানটি ভুমিষ্ঠ হয়ে ওঁয়া ওঁয়া শব্দ তোলে, তখন তার ঠোঁটের কোণে ভেসে আসে পৃথিবী জয়ের হাসি। মাতৃত্ব লাভের পরিপূর্ণ স্বাদ। বাংলাদেশ অনেক মা-ই সন্তান ভুমিষ্ঠ করতে গিয়ে নিদারুন এই কষ্ট সহ্য করেন। কেউ পাতার কুটিরে আর কেউবা এসি রুমের আলিশান কক্ষে। কেউ কেউ আবার এই নিদারুন কষ্ট সহ্য করতে না পেরে প্রাণ হারিয়ে ফেলেন। উচ্চবিত্তরা নামী-দামী হাসপাতালে ভর্তি করান প্রসববেদনাকারী মাকে। নিম্নবিত্ত যারা, তারা অনেকে গ্রামের ধাত্রী মাকে খবর পাঠিয়ে সন্তানকে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখান। কিন্তু সন্তান জন্মদানের বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। নাবিলা পরিবহনে সন্তান জন্ম দিলেন এক মা। সন্তানের নামও রাখলেন নাবিলা। অসহায় এই নারীকে সাহায্য করে মানবিকতার ইতিহাসে উজ্জ্বলতার স্বাক্ষর করলেন পীরগঞ্জ থানার এএসআই শহিদুল ইসলাম মন্ডল। গত ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ, রাত তখন ২.০০ টা বাজে। পীরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে ধাপের হাট পর্যন্ত রংপুর- ঢাকা মহাসড়কে রাত্রিকালীন টহল ডিউটিতে ফোর্সসহ নিয়োজিত ছিলেন এএসআই শহিদুল ইসলাম মন্ডল। যাত্রীদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্যই রাস্তার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তখন রাত্রী অনুমান ০৩ টা ১৫ মিনিট। পীরগঞ্জ থানাধীন ১৩ নং রামনাথপুর ইউনিয়নের মহাসড়কের উপর অবস্থিত খেজমতপুর বাজারে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ করে একটি বাস দ্রæতগতিতে তার সামন দিয়ে রংপুর অভিমুখে ছুটে যায়। এএসআই শহিদুল উক্ত বাসের ভেতরে নারী পুরুষের সম্মিলিত চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পান। বিষয়টি ডাকাতির ঘটনা মনে করে তিনি ও তার সাথে থাকা ফোর্সের সদস্যগণ বাসটি ডাকাতের কবলে পড়েছে এই সন্দেহে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন এবং বাসটির পেছনে ধাওয়া করেন। আনুমানিক ২/৩ কিলোমিটার ধাওয়া করার পর তাদের পিকআপ থেকে প্রদানকৃত থামানোর সংকেত দিলে বাসটি মহাসড়কের খেজমতপুর ঘেগারতল নামক স্থানে রাস্তার পাশে দাঁড় করায়। তখন বাসে থাকা ড্রাইভার ও যাত্রীদের কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করেন। বাস কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য যাত্রীরা জানায় যে, বাসে একজন গর্ভবতী মহিলা আছেন, তার প্রসব বেদনা উঠেছে। এজন্য নিকটস্থ হাসপাতালের অনুসন্ধান করার এবং সেখানে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বাসটি দ্রæততার সাথে চালানো হচ্ছিল। তখন তিনি উক্ত মহিলার সঙ্গে থাকা আত্মীয়স্বজনদের নিকট তার অবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরে তাৎক্ষনিকভাবে তাকে বাসে করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত বিপদজনক বলে মনে করেন। আর এ কারণেই এএসআই শহিদুল বাসে থাকা সমস্ত যাত্রীদের বাস থেকে নেমে নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে বলেন। এরপর নিজ বুদ্ধিমত্তায় বাসে থাকা ফোমের সিট গুলো আলাদা করে সঙ্গে থাকা অন্যান্য ফোর্সের সহায়তায় সিটগুলো বাস হতে নামিয়ে মহাসড়কের পাশে ফাঁকা জায়গায় বিছানা তৈরী করেন। যাত্রীদের সাথে থাকা কাপড় দ্বারা চারপাশে ঘেরাও করে আড়াল তৈরী করে দেন এবং সেই সাথে সন্তান প্রসবের কাজে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন নারী কাটার জন্য নতুন বেøড, টিস্যু, পানি. নারী বাধার জন্য সুতা সঙ্গে থাকা ফোর্সের সহায়তায় দূরবর্তী দোকান থেকে সংগ্রহ করে মহিলাদের দেন। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ঢাকা থেকে লালমনিরহাটগামী নাবিলা পরিবহনের উক্ত বাসে করে মহিলাটি তার বাবার বাড়ি লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা এলাকার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে পীরগঞ্জ থানাধীন ধাপেরহাট এলাকায় পেঁছিলে তিনি তীব্র প্রসব বেদনা ওঠে এবং গর্ভে থাকা সন্তান ভুমিষ্ঠ হবার উপক্রম হয়। তখন বাসে থাকা যাত্রীরা গভীর রাতে কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। ঘটনাস্থলে অপক্ষোয় থাকা যাত্রীসহ সকলে মহিলা ও তার অনাগত সন্তানের জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রাণ খুলে দোয়া করতে থাকে। কিছুক্ষনের মধ্যেই উক্ত মহিলা একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। তখন ঘটনাস্থলে থাকা যাত্রীদের মাঝে খুশীর বন্যা বয়ে যায়। খুশীতে কারো কারো চোখ দিয়ে পানিও গড়ে পড়তে দেখা যায়। উক্ত বাসে থাকা যাত্রীগন পুলিশের এই সার্বিক সহযোগিতা ও কাজকে অত্যন্ত মানবিক ও দৃষ্টান্ত বলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। ঘটনাস্থলের সকলের সম্মতিক্রমে ও অনুরোধে যাত্রীবাহী বাসটির নামে নামকরণ করে মেয়েটির নাম “নাবিলা” রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মা ও মেয়ে সুস্থ থাকায় কিছুক্ষণ পরে বাসটিকে পুনরায় গন্তব্যের দিকে রওনা দেয়। মানবিক এক প্রবাদ পুরুষ হচ্ছেন এএসআই শহিদুল ইসলাম মন্ডল। বাংলাদেশের সমগ্র পুলিশবাহিনীর জন্য যে দৃষ্টান্ত আর শিক্ষা তিনি রেখেছেন, তা বাংলার সাধারণ জনগণ সারাজীবন মনে রাখবে। শুধু বাসের যাত্রীরা কেন, সমগ্র বাংলাদেশ তাকে এই ধরনের মানবিক কাজে সার্বিক সহযোগীতা করার জন্য অত্যন্ত মানবিক ও মানবিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত বলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে। এ ব্যাপারে পীরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আনোয়ারুল ইসলাম আনোয়ার বলেন মানবিক কাজে পুলিশ সদস্য একটি দৃষ্টান্ত অবদান রেখেছেন, প্রচারের জন্য নয় মানুষ যেন, সকলে ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ হয়।