সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:০৪ অপরাহ্ন
আব্দুল করিম সরকার : রংপুরের পীরগঞ্জে নির্মল হাসির মৃত্যুর ১১ বছর কেটে গেলো নীরবে। আর ওই হাসির রাজা ছিলেন পীরগঞ্জ উপজেলার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মতিয়ার রহমান চৌধুরী খোকা। তিনি মেম্বার, চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রায় ৭৫ বছর বয়সে ২০১১ সালের ১৫ মার্চ রাত সোয়া ১০ টার দিকে নির্মল হাসির এই মানুষটি ইন্তেকাল করেন। সেই থেকে একটি নির্মল হাসিরও মৃত্যু ঘটে। মতিয়ার রহমান চৌধুরী খোকা মানে একটি নাম কিংবা ব্যক্তি নয়। তার ছিল বিশাল ভক্তবাহিনী। ফলে তিনি আস্ত একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। এর পিছনে ছিল জনতার ভালবাসা, তার সদা হাস্য মন, পরোপকারী ব্যক্তিত্ব, দায়িত্বশীল পদ। তিনি রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে পীরগঞ্জের রায়পুর ইউনিয়নের ধুলগাড়ী গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মতিয়ার রহমান চৌধুরী খোকা। তিনি মরহুম আলহাজ্ব আব্দুর রহমান এবং মাতা- মরহুমা গোলজান খাতুন চৌধুরীর একমাত্র ছেলে। বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন মতিয়ার রহমান চৌধুরী। তিনি একটানা ২৪ বছর রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন পদে নির্বাচিত হন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নেতৃত্ব দান করেন। অনেক আন্দোলন, লড়াই-সংগ্রামে দেশের জন্য লড়েছেন। বরাবরই তিনি জনগণের জন্য নিবেদিত ছিলেন। প্রায় ৭৫ বছরের পুরো জীবনটাই তার কাছে গল্পের মতো মনে হতো। তার মুখের নির্মল হাসিটাই জনগণের হৃদয়ে তাকে স্থান করে দিয়েছে। দুঃখ কষ্ট বিষন্নতার ছাপ ছিল না তার। একজন সফল পিতা হিসেবে তার সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ৩ ছেলে ৫ মেয়ে সবাই প্রতিষ্ঠিত। তার ৩ ছেলে এবং ২ মেয়ে আমেরিকা প্রবাসী। ১৯৫৪ সালে রংপুর জেলা স্কুল থেকে মতিয়ার রহমান চৌধুরী ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৫৬ সালে কারমাইকেল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলেও তার জীবনে আর বিদ্যার্জন করা সম্ভব হয়নি। তৎকালীন সময়ে তিনি কারমাইকেল কলেজে এ্যাথলেটিকস্ সম্পাদক নির্বাচিত হলে খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে অধ্যক্ষের সাথে তার তুমুল হট্রগোল বাঁধে। একপর্যায়ে তাকে প্রধান আসামী করে মামলা হলে তার লেখা পড়ায় ইতি ঘটে। অখন্ড দেশে ১৯৫৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মুসলীমলীগের পীরগঞ্জ থানার সাধারন সম্পাদক এবং রংপুর জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এর মাঝেই ৫৮ সালে রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ সাল থেকে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৪ বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত রংপুর জেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৬৯ সালে মুসলীম লীগ থেকে হ্যারিকেন প্রতীক নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেন। এরপর ইউপি চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় ১৯৭৯ সালে বিএনপি থেকে রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে ৩ বছর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের কাছে তিনি পরাজিত হন। যদিও তিনি মুসলীমলীগের দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তথাপিও দেশ মাতৃকার টানে পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিকভাবে সহায়তা করেছেন। মুসলীম লীগ করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার ইতিবাচক মনোভাব এবং ১৯৭০ এর নির্বাচনে প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করার পাঞ্জাব পুলিশ তাকে হত্যার জন্য অভিযান চালায়। সে কারণেই মতিয়ার রহমান চৌধুরী দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকেন। তিনি ভাইস চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় জেলা পরিষদের ফান্ড থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় অংকের আর্থিক সহায়তা করার বিষয়টি ফাঁস হয়ে পড়লে পাঞ্জাব পুলিশ তাকে সন্দেহের তালিকায় ফেলে। ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারী পীরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং এটিই তার রাজনৈতিক জীবনের শেষ নির্বাচন। ২০০৮ সালের গোড়ার দিকে মতিয়ার রহমান চৌধূরীর সাক্ষাত নেয়ার সময় তিনি দীর্ঘ জীবনের অনেক ঘটনার কথা বলতে বলতে হেসেছেন, কেঁদেছেন। তবে তার জীবনের সব ঘটনার সাথেই দেশ এবং জনগণের সংমিশ্রণ ছিল। ১৯৭০ এর নির্বাচনের সময় প্রার্থীতা নিয়ে মামলা হলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭৩ সালে সকল সংসদ প্রার্থীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। ওই ৭৩ সালেই আওয়ামীলীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসায় গিয়ে আওয়ামীলীগকে সহায়তা করার প্রতিশ্রæতি দেন তিনি। প্রতিশ্রুতি হিসেবেই তিনি ৯৬ এ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হন। দেশের জন্য তিনি যে কোন ভুমিকা নিতে পিছু পা হননি। ৭৫ বছরের বর্নাঢ্য জীবনেও তারুন্য ধরে রেখেছিলেন নির্মল হাসির মাধ্যমে। আর সেই হাসির মৃত্যু হয় ২০১১ সালের ১৫ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে চলে যান চিরতরে। পীরগঞ্জবাসী তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত, অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। তার জন্য হাজারো মানুষ ডুকরে কেঁদেছেন।।