শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৪১ পূর্বাহ্ন
দাম্পত্য জীবন মানবজীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর সূচনাপর্ব হলো বিবাহ। বিবাহ হলো ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ইবাদত। কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা বিবাহযোগ্যদের বিবাহ সম্পন্ন করো, তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছলতা দান করবেন; আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞানী।’ (সুরা: ২৪ নুর, আয়াত: ৩২)। সুন্নত তরিকায় বিবাহ সম্পাদন বরকতময় হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: নিশ্চয় সে বিয়ে বেশি বরকতপূর্ণ হয়, যে বিয়েতে খরচ কম হয়। (মুসনাদে আহমাদ ও মুস্তাদরাকে হাকিম)। এ ছাড়া বিয়ের সংশ্লিষ্ট আরও কিছু সুন্নত রয়েছে। যেমন: বিবাহ সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর হওয়া; অপচয়, অপব্যয় ও বিজাতীয় অপসংস্কৃতিমুক্ত হওয়া, যৌতুকের শর্ত না থাকা এবং সামর্থ্যের অধিক দেনমোহর ধার্য বা শর্ত না করা। (তাবারানি আওসাত, হাদিস নং-৩৬১২)। (আবু দাউদ: ২১০৬)। কিন্তু এখনকার একটা বিয়ে বাড়ি মানে নয়ন ঝলসানো আলোকসজ্জ্বা, আতশবাজির ফট ফট শব্দ, একটা ডিজিটাল ডিএসএলআর ভিডিও ক্যামেরা, আট-দশটা চক-চকে সু-সজ্জিত মাইক্রোবাস, অলঙ্কার আর পার্লারি সাজ-সজ্জার বিরাট একটা ফ্যাশন শো। বাড়িতে যেন বিয়ে নয়, বিয়ে হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারে; অনলাইনে পরিচয়ের মাধ্যমে। বধু বিদায়ে কন্যার কোন শোক নেই। হাসি-মুখে সে-ই যেন উল্টো বাবা-মাকে শান্তনা দিচ্ছে আর ক্যামেরায় পোজ দিয়ে দিয়ে ছবি তুলছে। কন্যা বিদায়ে যে মা-বাবার কোথায় লাগে তা বুঝতেও চায়না। কিন্তু, ছোটবেলায় নানা বাড়িতে আমি আমার ছোট খালার বিয়েতে দেখেছি। বিয়ের একমাস আগে সম্মন্ধ নিয়ে চলে আসেন ঘটক কান্তি নানা। তার কথামত নানা ভাই বড় মামা আর বাবাকে সাথে নিয়ে ছেলের বাড়ি দেখতে যেতেন সাইকেলে চড়ে। বাড়ি ও ছেলে পছন্দ হলে ছেলে পক্ষকে দাওয়াত দিয়ে আসতেন তারা। নির্ধারিত তারিখে ছেলে পক্ষ আসতেন মেয়ে দেখতে। হরেক রকম নাস্তা আর হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খাবার পর বাহিরে গোল হয়ে বসতেন চেয়ার আর বেঞ্চি নিয়ে। মেয়ের জন্য আলাদা একটা চেয়ার আর ছোট টেবিল পাতিয়ে রাখা হত। পানের বাটা হাতে মামীদের সাথে খালা এসে সেখানে বসলেন। তারপর শুরু হল বরপক্ষের একের পর এক প্রশ্ন। সে পবিত্র কোর-আন শরীফ পড়তে জানে কি-না, বাংলা লেখা-পড়া কতদুর পর্যন্ত, রান্না-বান্নায় দখল কতটুকু ইত্যাদি। অনেক সময় হাত-পায়ের আঙ্গুল আর মাথার চুল বের করেও দেখতেন। আমরা চার-পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। মেয়ে পছন্দ হলে মুরুব্বীরা খালার সাজানো বাটার পান খেয়ে পকেট থেকে নোট বের করে বকশিস দিতেন। ছেলের বাবা দিতেন সোনার আংটি অথবা টিকলি। তারপর ঘরে বসে বিয়ের দিন তারিখ ও অন্যান্য আনুষ্ঠিকতা নিয়ে আলোচনা চলত। পাশের ঘর থেকে নানী আর ছোট খালার কান্নার শব্দ আসে। নানা ভাই ধমক দিয়ে তা বন্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্ত এরপরেও চলে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না। এবার মা সহ মামীরাও যোগ দিল সেই কান্নায়। পরদিন থেকে চলত বিয়ের প্রস্তুতি। সকল আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত পৌঁছানো হত। হাট-বাজার করা থেকে শুরু করে উভয় পক্ষের বিয়ের পোশাক কেনার কাজটাও চলত সমান তালে। আমাদেরও নতুন পোশাক হত বিয়ে উপলক্ষে। কলাগাছ বাঁশের চ্যাপলা দিয়ে তৈরী করা হত বিয়ের গেট। গেট সাজানো হত রঙিন কাগজে নকশা কেটে কেটে। । বিয়ের আগের দিন পাড়ার সকলে মিলে খালার গায়ে হলুদের ব্যবস্থা করলেন। চারদিকে চারটি কলাগাছ পুঁতে তার মাঝখানে বসানো হত কন্যাকে। কলাগাছের চারপাশ ঘিরে গ্রামের মহিলারা গীত-আনন্দে মেতে উঠতেন। অন্যান্য নানীরা বৃদ্ধ, তবুও খালা আর মামীদের সাথে কোমর দুলিয়ে নাচছেন। এরপর শুরু হত ফোরন ডোবানোর পর্ব। চাইলোনে করে কয়েকটি ছোট মাটির প্লেটে সরিষার তেলে ভরিয়ে দিয়ে সলতের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হত। এটাকেই বলা হত বিয়ের ফোরন ডুবানো। কার সাথে চলত রঙের হোলি খেলা। নানা ভাইয়ের কথা, কমপক্ষে দশটা গরুর গাড়ি করতে হবে বিয়েতে। তাই গাড়ি ভাড়া করার জন্য বড় মামা আদিষ্ট হয়ে পাড়া বা গ্রাম ঘুরে ঘুরে সে সব গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করতে বেড়িয়ে পড়তেন। বিয়ে আনার দিন যথাসময়ে দশখানা গরুর গাড়ি এসে হাজির। সাথে দুটো মাইক। সবাই যথাসম্ভব সাজ-গোজ করে গাড়িতে উঠে পড়েছে। আমরা মাইক ওয়ালা গাড়িতেই উঠে পড়লাম। সারিবদ্ধ হয়ে গাড়ি গুলো বিয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করল। সাজুল মামার মুখ দিয়ে বাজানো তবলা আর দোতরায় ভাওয়াইয়ার সুর মাইকে বাজতে লাগল। ওর সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন ঢঙ্গে আমরাও গান গাইতে শুরু করলাম। গীত-নৃত্য-বাদ্যের তালে তালে বিয়ে নিয়ে ফিরতে রাত ভোর হয়ে যেত।